ভূতের রহস্য ও বিজ্ঞান

 ভূতের রহস্য বিজ্ঞান



অদ্রি, সানজিদা, সাকিব, মিতু, কুরাইশ, আর সারফারাজএই 'জন বন্ধু গ্রীষ্মের ছুটিতে একসঙ্গে সময় কাটানোর জন্য ঠিক করলো ঢাকার অদূরে একটা পুরনো জমিদারবাড়ি ভাড়া নেবে। বাড়িটা নির্জন, জঙ্গলের কাছাকাছি, আর সবচেয়ে বড় কথা, লোকে বলে সেখানে নাকি ভূতের উপদ্রব আছে। বন্ধুদের মধ্যে সানজিদা আর মিতু ভূতের গল্প শুনে একটু ভয় পেলেও বাকি চারজন, বিশেষ করে অদ্রি, বিষয়টাকে একেবারেই পাত্তা দিল না। অদ্রি একজন পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, যুক্তিবাদী আর বিজ্ঞানমনস্ক। তার কাছে ভূতের ধারণা নিতান্তই কুসংস্কার।

বাড়িটা বেশ পুরোনো, দেওয়ালের পলেস্তারা খসে পড়েছে, দরজা-জানালার কপাটগুলো ভাঙাচোরা। চারদিকে একটা গা ছমছমে নীরবতা। প্রথম কয়েকদিন সবকিছু স্বাভাবিকভাবেই কাটলো। কিন্তু তারপর শুরু হলো অদ্ভুত সব ঘটনা। রাতের বেলা কেউ যেন বাড়ির ভেতর ঘুরে বেড়ায়, হালকা পায়ের শব্দ শোনা যায়। কখনও আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যায় দরজা- জানালা। মোমবাতি জ্বালালে তার আলো নেচে ওঠে।

একদিন রাতে সবাই যখন একসঙ্গে বসে গল্প করছিল, হঠাৎ আলো নিভে গেল। প্রথমে সবাই ভেবেছিল হয়তো কারেন্ট চলে গেছে, কিন্তু পরক্ষণেই তারা দেখলো মোমবাতিগুলোও নিভে গেছে। ঘরে জমাট বাঁধা অন্ধকার। সানজিদা আর মিতু ভয়ে একে অপরের হাত শক্ত করে ধরলো। সাকিব টর্চলাইট জ্বালানোর জন্য হাত বাড়াতেই দেখলো টর্চটা নেই।

"এটা নিশ্চয়ই ভূতের কাজ," মিতু ভয়ে ভয়ে বলল।

"ভূতের কাজ নয়, এটা অন্য কিছু," অদ্রি গম্ভীর গলায় বলল। "ভয় পেয়ো না, আমি দেখছি।"

অদ্রি পকেট থেকে মোবাইল বের করে টর্চলাইট জ্বাললো। মৃদু আলোয় সে ঘরটা ভালো করে দেখল। সবকিছু আগের মতোই আছে, শুধু টর্চলাইটটা নেই।

পরের দিন সকালে অদ্রি জমিদার বাড়ির আশেপাশে ঘুরে ঘুরে সবকিছু খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। পুরনো দিনের স্থাপত্য, জঙ্গলের গাছপালা, আর বাড়ির ভেতরের পরিবেশসবকিছুই তার মনোযোগ আকর্ষণ করলো। সে জানতে পারলো, এই বাড়িটা প্রায় একশো বছরের পুরোনো এবং এখানে আগে অনেক মানুষের বাস ছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজন নাকি অস্বাভাবিকভাবে মারা গিয়েছিল।

দুপুরের দিকে অদ্রি বাড়ির পেছনের বাগানে একটা পুরোনো কুয়ো দেখতে পেল। কুয়োর মুখটা আগাছা আর লতাপাতা দিয়ে ঢাকা ছিল। সে কৌতূহলী হয়ে কুয়োর ভেতরে উঁকি মারলো। কুয়োর ভেতরটা অন্ধকার, কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

সেদিন রাতে আবার সেই একই ঘটনা ঘটলো। রাতের খাবার খাওয়ার সময় হঠাৎ আলো নিভে গেল, মোমবাতিগুলোও নিভে গেল। সানজিদা ভয়ে চিৎকার করে উঠলো।

"আর পারছি না, চল আমরা এখান থেকে চলে যাই," সানজিদা কাঁদতে কাঁদতে বলল।

"দাঁড়াও, একটু শান্ত হও," অদ্রি বলল। "আমি ব্যাপারটা দেখছি।"

অদ্রি আবার টর্চলাইট জ্বালিয়ে ঘরটা ভালো করে দেখলো। এবার সে লক্ষ করলো, ঘরের একটা কোণে একটা ছোট গর্ত। গর্তটা দিয়ে ঠান্ডা বাতাস আসছে।

"আমার মনে হয়, এই গর্তটা থেকেই বাতাস আসছে," অদ্রি বলল। "আর সেই বাতাসের কারণে মোমবাতিগুলো নিভে যাচ্ছে।"

পরের দিন সকালে অদ্রি গর্তটা খুঁটিয়ে দেখলো। সে বুঝতে পারলো, এটা আসলে একটা পুরনো ভেন্টিলেশন সিস্টেমের অংশ। জমিদারবাড়ির পুরোনো নকশায় এমন ভেন্টিলেশন সিস্টেম থাকার কথা।

"তাহলে রাতের বেলা যে পায়ের শব্দ শোনা যায়, সেটার কারণ কী?" কুরাইশ জানতে চাইলো।

"আমার মনে হয়, সেটা কাঠবিড়ালি বা অন্য কোনো ছোট প্রাণীর আওয়াজ," অদ্রি বলল। "পুরোনো বাড়িতে ইঁদুর বা কাঠবিড়ালি থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।"

অদ্রি বন্ধুদের বোঝানোর চেষ্টা করলো যে তারা যা দেখছে বা শুনছে, তার সবকিছুই আসলে সাধারণ ঘটনা, যার পেছনে বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা আছে। কিন্তু সানজিদা আর মিতু কিছুতেই মানতে রাজি হচ্ছিল না। তাদের ধারণা, এটা ভূতেরই কাজ।

অদ্রি তখন একটা সিদ্ধান্ত নিলো। সে ঠিক করলো, সে প্রমাণ করবে যে এই বাড়িতে ভৌতিক বলে কিছুই নেই, সবকিছুই আসলে বিজ্ঞানসম্মত।

সেই রাতে অদ্রি একটা বিশেষ পরিকল্পনা করলো। সে একটা থার্মাল ক্যামেরা নিয়ে এলো এবং বাড়ির বিভিন্ন জায়গায় সেটা বসিয়ে দিল। থার্মাল ক্যামেরা দিয়ে তাপমাত্রা পরিবর্তন রেকর্ড করা যায়। যদি সত্যিই কোনো ভূত থাকে, তাহলে তার শরীর থেকে তাপ নির্গত হওয়ার কথা এবং সেটা ক্যামেরায় ধরা পড়ার কথা।

সারারাত ধরে ক্যামেরা চললো, কিন্তু কিছুই ধরা পড়লো না। কোথাও কোনো অস্বাভাবিক তাপমাত্রার পরিবর্তন দেখা গেল না।

পরের দিন সকালে অদ্রি বন্ধুদের ক্যামেরার ফুটেজ দেখালো। ফুটেজে সবকিছু স্বাভাবিক দেখা যাচ্ছে। কোনো ভূত বা অন্য কোনো অস্বাভাবিক কিছু নেই।

"তাহলে তোমরা কী বলবে?" অদ্রি বলল। "এটা কি প্রমাণ করে না যে এখানে কোনো ভূত নেই?"

সানজিদা আর মিতু তখনও পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছিল না। তারা বলল, "হয়তো ভূত ক্যামেরার সামনে আসে না।"

অদ্রি হাল ছাড়লো না। সে আরও একটা পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলো। সে একটা সাউন্ড রেকর্ডার নিয়ে এলো এবং সেটা বাড়ির বিভিন্ন জায়গায় রেখে দিল। যদি কোনো অস্বাভাবিক শব্দ হয়, তাহলে সেটা রেকর্ডারে ধরা পড়বে।

সারারাত ধরে রেকর্ডার চললো। পরের দিন সকালে অদ্রি রেকর্ড করা শব্দগুলো শুনলো। সে শুনতে পেল, রাতের বেলা বাতাসের শব্দ, পোকামাকড়ের আওয়াজ, আর কিছু ছোট প্রাণীর পায়ের শব্দ। কিন্তু কোনো অস্বাভাবিক বা ভৌতিক শব্দ নেই।

অদ্রি বন্ধুদের রেকর্ড করা শব্দগুলো শোনালো। এবার সানজিদা আর মিতু কিছুটা হলেও বুঝতে পারলো যে তারা যা শুনেছে, তা আসলে সাধারণ শব্দ।

এরপর অদ্রি বাড়ির পেছনের বাগানের সেই পুরোনো কুয়োটার দিকে মনোযোগ দিল। তার মনে হচ্ছিল, এই কুয়োর সঙ্গে নিশ্চয়ই কোনো রহস্য জড়িয়ে আছে।

সে কুয়োর মুখ থেকে লতাপাতা সরিয়ে ফেললো এবং একটা দড়ি দিয়ে বালতি নামিয়ে কুয়োর ভেতর থেকে জল তুললো। জল তোলার পর সে দেখলো, বালতির মধ্যে কিছু পুরোনো জিনিসপত্র আটকে আছে।

সে বালতি থেকে জিনিসপত্রগুলো বের করে আনলো। সেগুলোর মধ্যে ছিল পুরোনো কিছু বাসনপত্র, একটা মরচে ধরা ছুরি, আর একটা পুরোনো ডায়েরি।

অদ্রি ডায়েরিটা খুলে পড়তে শুরু করলো। ডায়েরিটা এক জমিদারের লেখা। সেই জমিদার তার ডায়েরিতে এই বাড়ির ইতিহাস লিখে গেছেন। তিনি লিখেছেন, কীভাবে তিনি এই বাড়িটা তৈরি করেছিলেন, কীভাবে তার পরিবার এখানে সুখে-শান্তিতে বাস করতো।

ডায়েরির শেষ দিকে জমিদার লিখেছেন, কীভাবে তার ছেলে রহস্যজনকভাবে মারা যায়। তিনি সন্দেহ করেছিলেন, কেউ তার ছেলেকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেছে। কিন্তু তিনি কখনও প্রমাণ করতে পারেননি।

ডায়েরিটা পড়ার পর অদ্রির মনে একটা নতুন ধারণা জন্ম নিলো। সে বুঝতে পারলো, এই বাড়িতে যা কিছু ঘটছে, তার পেছনে কোনো ভৌতিক কারণ নেই, বরং এর পেছনে লুকিয়ে আছে পুরোনো কোনো রহস্য।

অদ্রি বন্ধুদের ডায়েরির কথা জানালো। সবাই একসঙ্গে বসে ডায়েরিটা পড়লো। ডায়েরিটা পড়ার পর তাদের মনে হলো, জমিদারের ছেলের মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন করা দরকার।

তারা সবাই মিলে সেই রহস্যের তদন্ত শুরু করলো। তারা জানতে পারলো, জমিদারের ছেলের মৃত্যুর পর বাড়ির অনেকেই সন্দেহভাজন ছিল। তাদের মধ্যে ছিলেন জমিদারের ভাই, যিনি সম্পত্তির লোভে জমিদারকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।

অদ্রি আর তার বন্ধুরা সেই সময়ের কিছু পুরোনো নথিপত্র খুঁজে বের করলো। তারা জানতে পারলো, জমিদারের ভাই আসলে তার ছেলেকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেছিল। এরপর সে ঘটনাটাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল।

অদ্রি আর তার বন্ধুরা সেই তথ্যগুলো পুলিশের কাছে জমা দিল। পুলিশ তদন্ত করে জানতে পারলো, জমিদারের ভাইয়ের দোষ প্রমাণিত হয়েছে।

রহস্য উদঘাটন হওয়ার পর জমিদারবাড়ির পরিবেশ শান্ত হয়ে গেল। রাতের বেলা আর কোনো অদ্ভুত শব্দ শোনা যায় না, মোমবাতিগুলোও আর নেভে না। সানজিদা আর মিতু বুঝতে পারলো, তাদের ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।

অদ্রি প্রমাণ করলো যে ভৌতিক বলে কিছু নেই, সব ঘটনার পেছনে বিজ্ঞানসম্মত কারণ রয়েছে। কুসংস্কারের কোনো ভিত্তি নেই।

গল্পটা শেষ হয় একটা সুন্দর সকালে। অদ্রি, সানজিদা, সাকিব, মিতু, কুরাইশ আর সারফারাজসবাই মিলে জমিদারবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তারা হাসছে, কারণ তারা একটা কঠিন সমস্যার সমাধান করতে পেরেছে। তারা বুঝতে পেরেছে, বিজ্ঞান আর যুক্তির সাহায্যে যেকোনো সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।

অদ্রি আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সে জানে, কুসংস্কার সমাজের একটা বড় শত্রু। আর এই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে বিজ্ঞান আর যুক্তির আলো জ্বালিয়ে রাখতে হবে।

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন